চোখের পলকে – পার্ট ১

চোখের পলকে – পার্ট ১

অঙ্কন রায় চৌধুরি, চৌধুরি অ্যান্ড সন্স-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সদ্যই ওঁর বাবা তাঁকে এই পদে নিয়োগ করেছেন। অঙ্কন গবেষণা করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি—ব্যবসা সামলাতে হবে, বাবার কড়া নির্দেশ।

অঙ্কনকে সবাই জানে পরিবারের বাধ্য সন্তান হিসেবে। শ্যামবর্ণ চেহারা, ট্রিম করা চাপদাঁড়ি, উঁচু লম্বা একজন সুপুরুষ। কলেজের সেই সময়ে, কিংবা রাস্তায় বা অফিসে—মেয়েরা অঙ্কনকে একবার দেখবে বলে কত কাণ্ড করে বসত।

কিন্তু অঙ্কন আজকাল এক চেহারায় ডুবে আছে। ভুলতে পারছে না সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটিকে। আজও সেই রাতের সিগনালের ঘটনাটা ভুলতে পারেনি অঙ্কন।

সেদিন বোর্ড মিটিং সেরে বেরিয়েছে, দুপুর থেকেই আকাশের মুখ ভার। রাস্তায় মেঘভাঙা বৃষ্টি আর সেই সঙ্গে বজ্রপাত। সিগনালে দাঁড়িয়ে ওঁর মার্সিডিস। রাস্তায় লোকজন নেই, গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না—অনেক বার চেষ্টার পরও না। অঙ্কন চিন্তায় পড়ে গেল। তড়িঘড়ি করে ফোন করা হলো মেকানিককে। তারা গাড়ি রাস্তায় ছেড়ে দিতে বলল। অঙ্কন তাই করলেন।

তাহলে উপায়? উপায় একটাই—ক্যাব নেওয়া। পাশের বাসস্টপে যেতে গিয়ে কাকভেজা ভিজে গেল অঙ্কন। ফোন হাতে নিতেই “টু টু টু” করে ব্যাটারি ডাউন। অঙ্কনের একটু রাগ হলো—ক্যাব বুক করবে কী করে?

বাসস্ট্যান্ডের চেয়ারে বসে এ কথা সে কথা ভাবতে থাকে। বাঁদিকে চোখ যেতেই দেখে, একটি মেয়ে বসে আছে। নীল জর্জেটের শাড়ি, কোঁকড়ানো চুলগুলো কান ঘেঁষে মুখে লেগে আছে—মুখটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটি ভিজে গেছে, কাঁপছে। অঙ্কন অনেকক্ষণ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কোনো সাড়া পেল না।

এদিকে বৃষ্টি বাড়ছে, মেঘ ডাকছে পালা করে। ভয় লাগছে অঙ্কনের। মেয়েটি বোধহয় আরও ভয় পাচ্ছে। অনেক সাত-পাঁচ ভেবে অঙ্কন এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনই মেয়েটি জাপটে অঙ্কনের বুকে মাথা গুঁজে দিল। সে স্পর্শ সাংঘাতিক—বিদ্যুতের শক লাগার মতো মনে হলো সারা শরীরে। অঙ্কন কিছু সময়ের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সামলে নিল নিজেকে।

বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে আলতো করে চুলগুলো সরিয়ে দিতে থাকে। মেয়েটি হালকা করে মুখটা উঁচু করল, কিন্তু অন্ধকারে মুখটা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু মুখটা উঁচু করে মেয়েটি অঙ্কনের দিকে তাকায়। সারাটা দিক আলো করে বিদ্যুতের ঝলকানিতে মেয়েটির চোখ-মুখ স্পষ্ট দেখতে পায়।

অঙ্কন অবাক চোখে দেখছে এই অচেনা মেয়েটিকে। মেয়েটির চোখে দোমড়ানো-মুচড়ানো স্বপ্ন খেলছে। কী আছে এই চোখে? লাল, ভেজা, কাঁপাকাঁপা ঠোঁট যেন হাজার কথা বলছে। মেয়েটির নিঃশ্বাসে বেঁচে থাকার ইচ্ছে প্রবল, মুখে চিকচিক হাসি। অঙ্কন শুধু তাকিয়ে থাকে—এমন মেয়ে সে আগে কখনও দেখেনি।

সময় এগিয়ে যায়। বৃষ্টি থামে। মেয়েটি চোখের পলকে অঙ্কনের হাত ছেড়ে দৌড়ে চলে যায়।

নাম জানা হলো না, ঠিকানা জানা হলো না।
আজ পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে—দেখা হলো না একবারও…

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *